সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

"কচুরিপানা বোঝা নয় সম্পদ"

বেণুবর্ণা অধিকারী

দেশে কচুরিপানার ব্যবহার না হওয়ায় বিজ্ঞানী ড. মহীউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেছেন “হায়রে কচুরিপানা বাংলার কৃষক তোরে চিনল না”।
কচুরিপানা হলো ভাসমান এমন একটি প্রাকৃতিক জলজ উদ্ভিদ। অন্য দেশ থেকে এই দেশে এসে সে আমাদের অনেকের কাছে আগ্রাসী জলজ গাছ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। কারণ গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকায় এটি খুব দ্রুত বংশবিস্তার করে, এমনকি ৬ দিনেরও কম সময়ে সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে যায়। ফুল ফোটার ১-২ দিন পর শুকিয়ে যায়। সকল ফুল শুকিয়ে যাওয়ার ১৮ দিন পর বীজগুলো বিমুক্ত হয়। ৫০ দিনের মধ্যে প্রতিটি ফুল হতে প্রায় ১০০০ নতুন কচুরিপানার জন্ম হয়। একটি গাছ থেকে ৫০০০ এর অধিক বীজ উৎপন্ন হয়, এই বীজ ৩০ বছর পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে।
এই ভয়ঙ্কর আগ্রাসী কচুরিপানাকে দূর করা মোটেও সম্ভব না যতদিন না এটাকে আমরা উপকারী গাছ হিসেবে ব্যবহার না করবো। আমরা যখনই এই পানাকে কাজে লাগাতে পারবো তখনই এই গাছ কমে যাবে। সবকিছুরই ভাল-মন্দ দুই দিকই রয়েছে। ভাল দিকটিকে ফুটিয়ে তোলা চ্যালেঞ্জ। কচুরিপানা যেমন ক্ষতিকর এবং নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক, তেমনই এর উপযুক্ত ব্যবহারে সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ কচুরিপানা রপ্তানি করছে। সুদূর ভবিষ্যতে হয়তো বাংলাদেশও কচুরিপানা থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথে এগিয়ে যাবে।

কচুরিপানা দূষণের চেয়ে অনেক বেশি উপকারে আসতে পারে যদি আমরা এর ব্যবহারগুলোকে বাস্তবায়ন করি।

১) কচুরিপানা অতিমাত্রার দূষণ ও বিষাক্ততা সহ্য করতে পারে।
মার্কারী ও লেডের মত বিষাক্ত পদার্থ এরা শিকড়ের মাধ্যমে পানি থেকে শুষে নেয়। তাই পানির বিষাক্ততা ও দূষণ কমাতে কচুরিপানার চাষ অত্যন্ত উপকারী।
২) পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে কচুরিপানা মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যদিও আমি জানিনা সত্যি কেউ খায় কিনা?
৩) ভেষজ চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা নাকি আছে।
৪) বায়োগ্যাস উৎপাদনের জন্য এটি চমৎকার একটি উৎস। ক্ষেত্র বিশেষে কচুরিপানা থেকে গোবরের চাইতেও বেশি বায়োগ্যাস উৎপাদন করা যায়।
৫) পূর্ব এশিয়াতে শুকনো কচুরিপানা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং এর ছাই কৃষকরা সার হিসাবে জমিতে ব্যবহার করে।
৬) সবুজ কচুরিপানা জৈব সার হিসাবেও জমিতে ব্যবহার করা যায় (সরাসরি অথবা মালচ্ হিসাবে)।
৭) বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কচুরিপানা দিয়ে কাগজ ও রঙিন কাগজ তৈরি করা যায়। 🤔
৮) কচুরিপানা কেঁচো উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সহায়ক।
৯) সম্প্রতি কচুরিপানা থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির পদ্ধতিও আবিষ্কৃত হয়েছে।😜
১০) কচুরিপানার আসবাবপত্রও তৈরি করা যায়। এই ফার্নিচারগুলো যেমন পরিবেশ-বান্ধব তেমনই আকর্ষণীয়। প্রথম দেখায় কচুরিপানা দিয়ে তৈরি ফার্নিচারগুলোকে বেতের ফার্নিচার মনে হতে পারে। কিন্তু এগুলো বেতের তুলনায় অনেক বেশি নরম, নমনীয়, স্থিতিস্থাপক এবং অন্দরে বেশ আধুনিকতার প্রকাশ ঘটায়।
কচুরিপানায় ফার্নিচার তৈরি প্রক্রিয়াঃ
কচুরিপানা ব্যবহার করে ফার্নিচার তৈরিতে বড় মেশিনের প্রয়োজন পড়ে না। একেবারেই সাদাসিধে প্রক্রিয়ায় অসাধারণ সব ফার্নিচার তৈরি হয়। যেমন-
প্রথমে ডোবা-নালা থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে কচুরিপানা তুলে আনা হয়।
সংগৃহীত কচুরিপানাগুলোকে ভালভাবে পরিষ্কার করে ডাঁটা থেকে পাতাগুলোকে আলাদা করা হয়।
এরপর প্রাপ্ত কচুরিপানার ডাঁটাগুলোকে ভালমতো রোদে শুকাতে হয়।
শুকনো ডাঁটাগুলোর উপরের আঁশের মতো অংশটুকু সরিয়ে নিলেই ফিতার মত অংশের দেখা মিলবে।
এবার কাঠের বা স্টিলের তৈরি মনের মতো গঠনের ফ্রেমে প্রাপ্ত ফিতা পেঁচিয়ে এবং বুননের মাধ্যমে শৈল্পিক রূপ দেওয়া হয়। তারপর ইচ্ছেমত রঙ ব্যবহার করে চকচকে ভাব আনা যাবে।
ব্যস, তৈরি হয়ে গেল পরিবেশ-বান্ধব ফার্নিচার। এভাবে আপনি সোফা, টি-টেবিল, সেন্টার টেবিল, বুকশেলফ ইত্যাদি তৈরি করতে পারেন।
মজার বিষয় হলো কচুরিপানা থেকে বানানো ফার্নিচারগুলোর এক ধরনের নিজস্ব সুগন্ধ আছে। এই গন্ধ খুব কড়াও নয়, আবার একেবারেই বোঝা যায় না তেমনও নয়। ঘরে এই ফার্নিচারগুলো সর্বক্ষণই প্রাকৃতিক গন্ধে আপনার ভেতর এক বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি করবে।
এই ফার্নিচার পরিষ্কার রাখা বেশ সহজ। শুধু খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশ সময় ধরে তা ভেজা না থাকে। ভিজে গেলে রোদে বা ড্রায়ার দিয়ে খুব ভালভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। শুধুমাত্র দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করেই পরিষ্কার রাখতে পারেন আপনার এই পরিবেশ-বান্ধব ফার্নিচারগুলো-
একটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে প্রতিদিনের জমা ধুলো পরিষ্কার করে ফেলতে পারেন, পাশাপাশি নাইলনের ব্রাশ ব্যবহার করতে পারেন।
দাগ লাগলে বা দাগ হয়ে গেলে সামান্য একটু সাবান আর পানি দিয়ে ধুয়ে ভালভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
১১) এছাড়া কচুরিপানা বাঁশ দিয়ে আটসাট করে বেঁধে ভাসমান বাগান বানানো যায়, এর ভেতরে মাটি মিশিয়ে বেড করে গাছপালা লাগানো যায়। ইচ্ছে হলে এই বাগান বেয়াইন বা সইয়ের বাড়ি গিফট হিসেবে পাঠাতে পারবেন। 😁
১২) গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে কচুরি পানার চাহিদা অনেক আগে থেকেই আছে, তবে কচুরিপানার সাথে অন্যান্য খাবারও দিতে হবে নইলে গরুর দুধে ঘনত্ব কমে যায়। এছাড়া এখন দেশে প্রচুর টার্কি পালন করা হয়। এই টার্কি গুলোর প্রধান প্রাকৃতিক খাবার হলো কচুরিপানা। কচুরিপানা পর্যাপ্ত না থাকলে এতো সহজে এদেশে টার্কি পালন করা যেত না।

Image may contain: plant, flower, nature and outdoor

ছবি ও লেখাসূত্র: বৃক্ষকথা, নানান পত্রিকা, উইকিমিডিয়া কমন্স
source: giskaa.com,কচুরিপানায় তৈরি খাট; source: art-craft.com, কচুরিপানার সোফায় আধুনিকতার ছোঁয়া; source: made-in-china.com,
কাঠের ফ্রেমে কচুরিপানার ফিতাগুলো লাগানো হচ্ছে; source: gardenfurniture.co.ukNo photo description available.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শুষনি শাক চেনেন কি?

শুষনি শাক (Marsilea minuta)  হাইপারটেনশন ও ঘুমজনিত সমস্যার মহৌষধ হিসেবে শুসনি শাক ব্যবহার করেন ময়মনসিংহের গারো ও কোচ উপজাতিরা। তারা এর রস ব্যবহার করেন কাশি ও শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগের ওষুধ হিসেবে। এটিকে শাক হিসেবেও রান্না করে খান তারা। ডঃ অসীমা চাটার্জী এই শাক থেকে এপিলেপ্সির ঔষধ আবিস্কারের পেপার বের করেছেন। বাংলাদেশের সর্বত্রই এ উদ্ভিদটি পাওয়া যায়। অনেকে শুষনী আর আমরুলি শাককে একই মনে করেন। আসলে শুষনি শাকে পাতা ৪ ভাজ, কিন্তু আমরুলি হলো ৩। আরেকটা পার্থক্য হলো শুষনী শাক টক স্বাদযুক্ত নয়, কিন্তু আমরুলি টক। এর বৈজ্ঞানিক নাম Marsilea minuta  আমরুল শাক থেকে শুষনি শাক পাতা আকারে বড়। তাছাড়া আমরুল লতানে ছোট গুল্ম উদ্ভিদ হলেও শুষনি সেরকমটি মোটেও নয়। শুষনি শাক

বৃক্ষকথা, Brikkho-Kotha: পাদাউকের প্রতি ভালবাসা

বৃক্ষকথা, Brikkho-Kotha: পাদাউকের প্রতি ভালবাসা : পাদাউক গাছ মুগ্ধ হতাম যার বিশালতা আর পাতার বিন্যাসে, কল্পনা ছিল তার ফুল না জানি কেমন হবে? ভর দুপুরে একরাশ রৌদ্র গায়ে মেখে ছুটে গেলাম সেই...

আমার কানাইবাঁশি

বেণুবর্ণা অধিকারী যে রঙ ঈর্ষনীয় অনেক ফুলের কাছে। অথচ সে খুবই ক্ষুদ্র, অবহেলিত। " ফুল বলে ধন্য আমি, ধন্য আমি মাটির 'পরে" এটা কানছিঁড়া/ কানাইবাঁশি/ঘাসফুল/কানশিরা/ কানদুলি/ কানাইলতা। এর বৈজ্ঞানিক নাম Commelina benghalensis. নানাবিধ ঔষধি গুণসম্পন্ন এই ক্ষুদে গাছ। মূলতঃ জীবানু নাশক গুল্ম। কানের ইনফেকশনে বা চোখের অঞ্জলি হলে এর রস করে দিলে উপশম হয়, গাছকে একটু গরম করে তারপর রস বের করে দিতে হয়। এছাড়া কুষ্ঠ, একজিমা, দাদ রোগেও এর প্রচলন আছে। পোকার আক্রমনের প্রদাহে এর রস লাগালে দ্রুত আরোগ্য হয়। Commelinaceae পরিবারের গাছ। অনেকে একে জোনাকি শাক বা পাতা বলে থাকে। নরম কাণ্ড বিশিষ্ট এই গাছ ছায়ায় নিজেদের কলোনী করে বাস করে। পাতার গোড়ায় ছোট্ট নীল ফুল আর এর পাতার সবুজতা মনকে সজীব করে। অনেকেই একে শাক হিসেবে খেয়ে থাকেন। তবে কি কারণে খান এবং খেতে কেমন জানিনা। এর আরো কোন ব্যবহার কি আছে?